আমের নাম ‘গৌড়মতি’। যেমন বাহারি নাম, তেমনি এর গুণ। আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাজারো আমের মধ্যে অনন্য এই আম। বাংলার ঐতিহাসিক প্রাচীন জনপদ গৌড়ের নামানুসারে আমটির নাম রাখা হয়েছে গৌড়মতি। অতি সুগন্ধি ন্যাংড়া ও টক-মিষ্টি আশ্বিনা জাতের আমের সংকরায়নে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট গৌড়মতি নাবি জাতের আম। এটি স্বাদ-গন্ধ-মিষ্টতায় অনন্য। ২০১৩ সালে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মঞ্জুরুল হক প্রথম এই নামটি দিয়েছিলেন। পরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি-১২ নামে গৌড়মতিকে অবমুক্ত করে।
এদিকে খ্যাতির কারণে জন্মস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গৌড়মতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের পার্বত্যাঞ্চলসহ সারা দেশে। লেট ভ্যারাইটি (নাবি) বা নামলা জাতের গৌড়মতির বিপুল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দেখছেন চাষিরা। মৌসুমে সব জাতের আম আহরণ যেখানে প্রায় শেষের পথে ঠিক সেই সময়ে বাজারে এসে আলোড়ন তুলেছে গৌড়মতি। জীবনচক্র অনুযায়ী এই আম বাগানে ও বাজারে থাকবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এর মুকুল হয় মে মাসে। পাকা শুরু হয় জুলাই মাসে। বর্তমানে উন্নত মানের গৌড়মতি এক মনের দাম ৭-৮ হাজার টাকা। অন্য মানেরগুলোর দাম ৫-৬ হাজার টাকা মন। গত কয়েক বছরে গৌড়মতি বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা মন দরে।
আমচাষি ও কৃষিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গৌড়মতি স্বাদে ন্যাংড়া আমের চেয়েও বেশি মিষ্টি এবং এর মিষ্টতার পরিমাণ ২৬ শতাংশ, যা যে কোনো জাতের আমের চেয়ে সর্বোচ্চ। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার খনিজ উপাদান। গৌড়মতি আকারে বেশ বড়, প্রায় গোলাকার এবং গাঢ় হলুদ রঙের হয়ে থাকে। পরিপক্ব হলে একেকটির ওজন হয় ৪৫০-৬০০ গ্রাম পর্যন্ত। শাঁস ও আঁশবিহীন গৌড়মতির আঁটি ও খোসা পাতলা হওয়ায় খাবারযোগ্য অংশ বেশি। অন্যান্য আমে খাবারযোগ্য অংশের পরিমাণ যেখানে ৮০-৮২ ভাগ সেখানে গৌড়মতির খাবারযোগ্য অংশ ৯৩ ভাগ। এই জাতটি নিয়মিত ফল দিয়ে থাকে। পাঁচ বছর বয়সি একেকটি গাছ থেকে সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই মন আম পাওয়া যায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে দুর্লভপুর মাস্টারপাড়া এলাকায় কয়েক বছর ধরে ১২ বিঘা জমিতে অন্য জাতের আমের সঙ্গে গৌড়মতি চাষ করছেন আহসান হাবিব। কয়েকদিন আগে বাগান থেকে গৌড়মতি আহরণ শুরু করেছেন তিনি। অন্য জাতের আমগাছের চারা কলম পদ্ধতিতে গৌড়মতির চাষ করছেন। তিনি জানান, এক বিঘায় গৌড়মতির দুইশ গাছ রোপণ করা সম্ভব। রোপণের দুই বছর পর থেকে ফল পাওয়া যায়। গাছের বয়স যত বাড়ে ফলনও তত বেশি হয়। ২০ বছর বয়সি গৌড়মতির একেক গাছ থেকে ৮-১০ মন পর্যন্ত আম পাওয়া সম্ভব। গৌড়মতির রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এই আম পচনশীলতার দিক থেকেও অধিক সহনীয়। পাকা গৌড়মতি আম গাছ থেকে নামানোর সাত থেকে ১০ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে। তিনি আরও জানান, বিশেষ এই জাতের আমগাছের বৈশিষ্ট্য হলো-আম ধরার পর গাছের গোড়া বা কাণ্ড থেকে নতুন পাতা বের হয়। ফলে প্রতিবছরই গাছে ফল ধরে। গৌড়মতি গাছের ফল ধারণ সক্ষমতাও বেশি।
গৌড়মতি আমকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি করেছে হর্টিকালচার ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সমন্বিত মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্প। ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমটির নামকরণ ও পরিচিতিকরণ করা হয়। উদ্যানতত্ত্ববিদরা গৌড়মতিকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। দেশের হর্টিকালচার সেন্টারগুলো গৌড়মতির চারা ও কলম উৎপাদন এবং সরবরাহ করে থাকে।
ঊষার আলো-এসএ