সারা দেশে দ্বিতীয় দিনের মতো ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালিত হয়। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অন্তত ৬৭ জন নিহত হন। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় ৬২ জন নিহত হন। ঢাকার বাইরে রংপুরে দুইজন, সাভার, সিলেট ও নরসিংদীতে একজন করে মোট পাঁচজনের মৃত্যু হয়। বিপুলসংখ্যক পুলিশ-র্যাবের পাশাপাশি ৭৫ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েনের পরও সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করা হয়।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসাবে এদিন সকাল থেকে দ্বিতীয় দিনের মতো কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালনে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। রামপুরা টিভি সেন্টারসংলগ্ন রাস্তা অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন তারা। মালিবাগ মোড় থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা বিক্ষোভকারীদের দখলে ছিল। পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ গভীর রাত পর্যন্ত চলে। বিকাল ৪টার পর বনশ্রী ও আফতাবনগর এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গুলশানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। বিশেষ করে গুলশান-বাড্ডা লিংক রোডে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এলাকায় আতঙ্ক নেমে আসে। গুলশানের রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ও প্লাস্টিকের ব্লক ফেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কংক্রিটের স্ল্যাব ফেলে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়।
জুমার নামাজের পরপরই প্রগতি সরণি অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন। এ সময় কুড়িল চৌরাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পালটাপালটি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। কালাচাঁদপুর এলাকার অলিগলিতে লাঠিসোঁটা ও ধারালো অস্ত্র হাতে সরকারদলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। বিকাল ৫টার দিকে কুড়িল এলাকায় র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে আকস্মিক টিয়ার গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরে প্রগতি সরণি এলাকার রাস্তায় স্টিলের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলেন বিক্ষুব্ধরা। নতুনবাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের ১০ জন আহত হন।
দুপুরের পর রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ইসলামী যুব আন্দোলন কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বায়তুল মোকাররমের গলিতে বেশকিছু শিক্ষার্থীকে আটকে রাখা হয়েছে-এমন খবরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষের পর বেলা ৩টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
কয়েকদিনের মতো শুক্রবারও দিনভর যাত্রাবাড়ী এলাকা ছিল রণক্ষেত্র। সকাল থেকে থেমে থেকে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। পালটাপালটি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় বেশ কয়েকজন নিহতের খবর পাওয়া যায়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে অর্ধশতাধিক আহত হন। এদিন রাজধানীর পুরান ঢাকা এলাকায় একাধিক হতাহতের ঘটনা ঘটে। সূত্রাপুরের পাতলা খান লেন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। এ ঘটনায় এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। পরে স্থানীয়দের অনেকে সড়ক অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। এছাড়া লক্ষ্মীবাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোকারীদের সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হন শতাধিক। তাদের মধ্যে একজন নিহত হন।
উত্তরা এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চারজনের লাশ আসে। আহত হয়ে হাসপাতালে আসা শতাধিক ব্যক্তির মধ্যে ৫০ জনের বেশিই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরসহ তার একদল কর্মী-সমর্থক উত্তরা এলাকায় শোডাউন দেন। এ সময় জাহাঙ্গীরের সমর্থকরা গুলি ছুড়লে শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়ার মুখে জাহাঙ্গীরের লোকজন পিছু হটলে তাদের বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোয় গণপরিবহণ ও ব্যক্তিগত যান চলাচল করতে দেখা যায়নি। ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক অনেক ফ্লাইট বাতিল করা হয়। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল চলাচলও বন্ধ ছিল। ঢাকার বাইরে খুলনার শিববাড়ী, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, রংপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুরে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সরকারের সঙ্গে যে কোনো ধরনের সংলাপের প্রস্তাব ফের প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র অন্দোলন ৯ দফা দাবি পেশ করে। আন্দোলনের সমন্বয়করা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা জানান।
ঊষার আলো-এসএ