গুম কমিশনের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, আওয়ামী লীগ আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ‘জঙ্গিবাদবিরোধী’ প্রচারণাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। মূলত জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানের ছায়াতলে ইসলামি উগ্রবাদের হুমকিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এবং শাসন দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে। কমিশন ইতোমধ্যে গুমের জন্য দায়ীদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করেছে।
কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, কমিশনে দায়ের করা ভুক্তভোগীদের ১৮৫০টি অভিযোগ বিশ্লেষণের মধ্যে থেকে ২৫৩ জন গুমের শিকার ব্যক্তির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এতে স্পষ্ট হয় যে, বিগত সরকারের শাসনামলে গুম একটি সুশৃঙ্খল ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে ‘জঙ্গিবাদবিরোধী’ অভিযানের ছায়াতলে ইসলামি উগ্রবাদের হুমকিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এবং শাসন দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে। যার ভুক্তভোগী ছিল মেধাবী শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পেশাজীবীরা।
এ প্রক্রিয়ায় তারা ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে অস্ত্র বানিয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন করেছে এবং নির্যাতন ও গোপন আটকের সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু করেছে, এমনকি সাধারণ নাগরিকদের বেআইনি পন্থায় বারবার ভারতীয় বাহিনীর হাতেও তুলে দিয়েছে,’ বলেন তিনি।
গুম কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, বিভিন্ন পটভূমি থেকে আসা ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতার এই সামঞ্জস্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে। ব্যাপারটা মোটেও এমন নয় যে একটি জঙ্গিবাদ দমন অভিযানে দু-একজন অসাবধানী কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক কিছু মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। বরং এটি ছিল একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দমনযন্ত্র, যা জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে।
তিনি আরও বলেন, কমিশনে দাখিল করা ৮১% অভিযোগ জীবিত ভিক্টিমদের হলেও ১৯% অভিযোগ ফেরত না আসাদের। গুম থেকে ফিরে না আসা ১২ জনের বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান সম্পন্ন হয়েছে এবং তাদের গুমের জন্য কারা দায়ী তা প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছি। চলমান অনুসন্ধানের স্বার্থে এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ফিরে না আসা ভিকটিমদের আরও অনেকের বিষয়েই কমিশনের কাজের অগ্রগতি রয়েছে। কিন্তু একেকজন ভিকটিমের বিষয়ে অনুসন্ধান সম্পন্ন করার আগে তথ্য প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। ফিরে না আসা ভিকটিমদের বিষয়ে অপরাধী এবং গুমের অপরাধ সংঘটনের স্থানসহ নানাবিধ বিষয়ে তথ্যের ঘাটতি বা পুরনো কললিস্ট না পাওয়াসহ নানারকম বিলম্বঘটিত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলেও কমিশন আন্তরিকতার সঙ্গে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
মইনুল ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে একটি বাস্তব হুমকি-বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ২০১৬ সালের হলি আর্টিজানে হামলার মতো ঘটনা এর প্রমাণ। তবে, এই হুমকি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সততা, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অটল থাকা জরুরি। সরকার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণাকে যখন রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তখন তা আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল না বরং বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা ডিজিএফআই, এনএসআই, র্যাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে র্যাব গুমের সঙ্গে বেশি জড়িত ছিল। বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের পাশাপাশি ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল। বাংলাদেশের যারা গুমে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভারতীয় যারা জড়িত তাদের বিষয়ে আমরা কিছু করতে পারবো না।’
গুম কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গুমের বিষয়টি জানতো, তবে প্রাতিষ্ঠান হিসেবে তারা এ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না।
ঊষার আলো-এসএ