UsharAlo logo
রবিবার, ২০শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ফিরে দেখা ২০ জুলাই: কারফিউ ভেঙে চলে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া

ঊষার আলো রিপোর্ট
জুলাই ২০, ২০২৫ ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

চব্বিশের ১৯ জুলাই (শুক্রবার) রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলির পর ছাত্র-জনতা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায়। এতে পুরো বাংলাদেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। রীতিমত যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরীতে পরিণত হয় রাজধানী। এর প্রেক্ষিতে ১৯ জুলাই দিবাগত রাত ১২টা থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করা হয়।

২০ জুলাই কারফিউর প্রথম দিনের সকালে ঢাকার রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম ছিল। হাতে গোনা কিছু দোকানপাট খোলা ছিল। সড়কে যানবাহনের সংখ্যাও হাতে গোনা ছিল।

তবে কারফিউ ভেঙে রামপুরা, যাত্রাবাড়ি, বাড্ডা, শাহজাদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলন চলে। পুলিশের সঙ্গে ঘটে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গুলির ঘটনা। সেদিন ঢাকায় প্রায় সব রাস্তায় সেনা সদস্যদের অবস্থান ও টহল চলছিল।

এদিকে, কারফিউ ঘোষণার রাতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গণভবনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ১৪ দলের নেতাদের বৈঠক হয়। সেদিন রাতেই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সরকারের তিন মন্ত্রীর কাছে তাদের দাবি পেশ করেন।

বৈঠকের পর তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক। কিন্তু আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, পদ্মায় ডেকে নিয়ে নাটক সাজানো হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, সেদিন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নিয়ে গিয়ে আমাদের দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করানো হয়। আমরা বলেছিলাম, রাষ্ট্রীয়ভাবে যেখানে শিক্ষার্থীদের হত্যা করা হয়েছে, সেখানে আমরা আলোচনা করতে পারি না। শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

দলটির উত্তরাঞ্চলের মূখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, সেদিন আমরা ৮ দফা দাবি দিয়েছিলাম। পাশাপাশি শাটডাউন কর্মসূচি চলমান রাখার ঘোষণাও ছিল। কিন্তু এ ঘোষণাটি প্রচার করতে দেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবন ও মেট্রোরেল স্টেশনে হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সেদিন অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মেট্রোরেলের ক্ষতিগ্রস্ত দুটি স্টেশন সচল হতে এক বছরের বেশি সময় লাগতে পারে বলেও জানায় ডিএমটিসিএল।

এদিন রাতেই অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ বাড়ানো হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছিলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এদিকে, কারফিউর কারণে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট বাতিল ও যাত্রী ভোগান্তি বেড়ে যায়। ওইদিনই পরিস্থিতি বিবেচনায় টানা দুই দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে ভুল সংবাদ প্রচার করছে। এ বিষয়ে তাদের চিঠি দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে ১৮ জুলাই থেকেই সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিল। এর ধারাবাহিকতা চলে ২০ জুলাইয়েও। ধারাবাহিকতা বজায় থাকে সাধারণ মানুষ হত্যার ক্ষেত্রেও।

২০ জুলাইয়েও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের সমর্থকদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে অন্তত ২১ জন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করা যায়, যাদের মধ্যে দুজন ছিলেন পুলিশের সদস্য।

আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের সমর্থক সন্ত্রাসীরা জ্বালাও-পোড়াওসহ সহিংসতা চালাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটা আন্দোলনে ভর করে বিএনপি-জামায়াত দেশের মানুষকে জিম্মি করার চেষ্টা করছে।

সেই সঙ্গে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম খান, রিজভীসহ বিএনপি-জামায়াতের ৭০ নেতাকর্মীকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। অন্যদিকে, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন তার পরিবার।

এ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার দমন-পীড়ন চালিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক সমন্বয়ক এদিন বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাদের ব্যানার ব্যবহার করে কেউ যদি রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায়, ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাতে চায়, তাহলে এটা তারা সমর্থন করবে না।

এদিন সকাল থেকেই রামপুরা, বনশ্রী ও বাড্ডা এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। সেখানেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সকাল থেকে ভাটারা এলাকায় ইউআইইউ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও আইইউবিসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

রাজধানীতে হেলিকপ্টার টহল অব্যাহত রাখে র‍্যাব। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশ চেকপোস্ট বসায়। এ সময় সংবাদকর্মীদের ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছ থেকে কারফিউ পাস নিয়ে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করতে হয়।

এদিন সিদ্ধিরগঞ্জে হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি ভবনে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। এতে ওই ভবনে থাকা হাইওয়ে পুলিশের সদস্যসহ শতাধিক মানুষ আটকা পড়েন। পরে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশ গিয়ে হেলিকপ্টারের সহায়তায় তাদের উদ্ধার করে।

মধ্যরাতে তুলে নেওয়া হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে—যিনি বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক।

নাহিদের মা সেদিন বলেছিলেন, নাহিদ রাজধানীর খিলগাঁও নন্দীপাড়ায় তার এক বন্ধুর বাসায় ছিলেন। ভোররাত আড়াইটার দিকে ৫০-৬০ জন লোক গিয়ে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে সেই বাসা থেকে নাহিদকে তুলে নিয়ে যান।

তবে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, নাহিদ নামে কাউকে ডিবি গ্রেফতার করেনি।

নাহিদের খোঁজে ডিবি কার্যালয়ের সামনে যান কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম।

পরে নাহিদের বাবা বদরুল ইসলাম জানান, সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে সিআইডি কার্যালয়ের সামনে থেকে ফেরার পথে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা সারজিস, হাসনাত ও হাসিবকে তুলে নিয়ে যায়।

পরে গভীর রাতে মিন্টো রোডের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়কের সঙ্গে বৈঠক করে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি করেছেন, তা যৌক্তিক এবং সমাধানযোগ্য।’

তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, ‘আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের তিন সমন্বয়কারী আমাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের আট দফা দাবি জানিয়েছেন। আমরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করব। আর শিক্ষার্থীদের পক্ষে বিভিন্ন পত্রিকায় যে ৯ দফার খবর ছাপা হয়েছে, তা কোনো মহলের ছড়ানো গুজব।’

সরকারের তরফে বলা হয়, এই বৈঠকের পর সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ তুলে নিতে বলেছেন সমন্বয়করা।

তবে, রাতে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে পাঠানো বার্তায় অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের কয়েকজন সমন্বয়ককে সরকারি বাহিনী হেফাজতে নিয়ে তাদের দিয়ে মনগড়া বক্তব্য তৈরি করে তা প্রচার করছে। আমাদের পূর্বঘোষিত নয় দফা দাবি বাস্তবায়ন হওয়ার আগ পর্যন্ত কমপ্লিট শাটডাউন অব্যাহত থাকবে।’

ঊষার আলো-এসএ