UsharAlo logo
মঙ্গলবার, ৮ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

মালিক চালক ও সার্ভেয়ার দায়ী

ঊষার আলো
জানুয়ারি ৪, ২০২২ ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

ঊষার আলো রিপোর্ট:  ইঞ্জিনের ত্রুটি থেকেই এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। লঞ্চটির তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী (বেশি হর্সপাওয়ার সম্পন্ন) এবং ২৪ বছরের পুরোনো দুটি ইঞ্জিন বসানোয় ত্রুটি দেখা দেয়।পুরোনো ইঞ্জিন থেকে ক্রমাগত নির্গত অতিরিক্ত তাপে লঞ্চের পাটাতন গরম হয়ে ওঠে। যে ডকইয়ার্ডে লঞ্চটিতে ইঞ্জিন বসানো হয় সেটির লাইসেন্সও মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। আর লঞ্চ পরিচালনায় থাকা শ্রমিকদের গাফিলতির কারণে আগুনের ভয়াবহতা ও প্রাণহানি বেড়েছে।

এ ছাড়া তিন মাস ধরে বসে থাকা লঞ্চটি কোনো পরীক্ষা ছাড়াই চলতে দিয়েছেন নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের সার্ভেয়ার ও ইন্সপেক্টর। লঞ্চটির কোনো বিমা ছিল না। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।সোমবার রাতে অভিযান-১০ লঞ্চের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। এ প্রতিবেদনে এসব ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আজ সচিব বরাবর তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেবে।

প্রতিবেদনে লঞ্চের চারজন মালিক, দুজন ইনচার্জ মাস্টার (চালক), সুকানি (চালকের সহকারী), দুইজন ড্রাইভার (ইঞ্জিন পরিচালনাকারী) ও লঞ্চের গ্রিজারকে (ড্রাইভারের সহকারী) সরাসরি দায়ী করা হয়েছে।এ ঘটনায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাউকে দায়ী করা হয়নি। তবে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের সদরঘাটের সার্ভেয়ার ও ইন্সপেক্টর এবং বিভিন্ন বিধিবিধান লঙ্ঘনের জন্য ডকইয়ার্ডের মালিককে দায়ী করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে লঞ্চের রোটেশন প্রথা বাতিল, টিকিট কেটে যাত্রী তোলাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। তবে প্রতিবেদন সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি তদন্ত কমিটির সদস্যরা।সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নাশকতা থেকে লঞ্চটিতে আগুন লেগেছে কি না, তা পরীক্ষা করেনি তদন্ত কমিটি। কারাগারে থাকা দুজন মাস্টারের বক্তব্য নিয়েছে। তবে দুজন ইনচার্জ ড্রাইভারের বক্তব্য পায়নি।

ওই দুজন রোববার নৌ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া গ্রিজারেরও বক্তব্য নিতে পারেনি কমিটি।তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লঞ্চ পরিচালনায় থাকা শ্রমিকরা আগুন লাগার পর যাত্রীদের না বাঁচিয়ে নিজেরা পালিয়ে গেছেন, যা ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬-এর পরিপন্থি।

২৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বরগুনা যাওয়ার পথে ঝালকাঠি পার হলে সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ আগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে সোমবার পর্যন্ত ৪৭ জনের মৃত্যু হয়।ওই ঘটনায় ২৪ ডিসেম্বর সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

পরবর্তী সময়ে কমিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরও তিন কার্যদিবস অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়। শেষ কার্যদিবসে সোমবার রাত ৯টার দিকে কমিটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে।নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. তোফায়েল ইসলাম কমিটির প্রধান ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম সদস্য সচিব ছিলেন।

কমিটিতে নৌপরিবহণ অধিদপ্তর, নৌপুলিশ, লঞ্চ মালিকদের প্রতিনিধি ছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির একাধিক সদস্য জানান, ইঞ্জিনের দায়িত্বে থাকা দুইজন ইনচার্জ ড্রাইভার ও গ্রিজারের বক্তব্য পায়নি তদন্ত কমিটি।ফলে অগ্নিকাণ্ডের উৎস সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেনি। তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার-বিশ্লেষণ, লঞ্চের যাত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যে কমিটি ইঞ্জিন রুম থেকে আগুন লাগার বিষয়টি জানতে পেরেছে।

জানা যায়, প্রতিবেদনে লঞ্চটিতে বেশি যাত্রী থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। লঞ্চটি সদরঘাট ছাড়ার সময়ে ভয়েজ ডিক্লারেশনে ২৭৫ জন যাত্রী থাকার কথা জানিয়েছিল লঞ্চ কর্তৃপক্ষ।নাবিক ও শ্রমিক মিলিয়ে ওই সংখ্যা ছিল ৩১০ জন। এছাড়া চাঁদপুর নৌবন্দর থেকে আরও ৫০ জন যাত্রী নেওয়ার কথা ওই বন্দরে ভয়েজ ডিক্লারেশন দিয়েছে।

লঞ্চটির সার্ভে সনদে রাতে ৪২০ জন এবং দিনে ৭৬০ জন বহনের সংখ্যা নির্ধারণ করা ছিল। ওই বিধান লঙ্ঘন করেছেন লঞ্চের মালিক ও পরিচালনায় দায়িত্বে থাকা শ্রমিকরা।এছাড়া লঞ্চে আগুন লাগলে তা নেভাতে সব অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ব্যবহার করা হয়নি। কয়েকটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র অব্যবহৃত অবস্থায় পেয়েছে।

আরও জানা যায়, নৌপরিবহণ অধিদপ্তরকে না জানিয়ে লঞ্চটি গত অক্টোবরে কেরানীগঞ্জের মাদারীপুর ডকইয়ার্ডে ডকিং করা হয়।ওই সময়ে নৌযানের আগের দুটি চায়না ইঞ্জিন পরিবর্তন করে ২৪ বছরের পুরোনো জাপানের ইঞ্জিন লাগানো হয়। লঞ্চটিতে এক হাজার একশ হর্স পাওয়ারসম্পন্ন ইঞ্জিন থাকার কথা ছিল।

কিন্তু পরিবর্তন করা ইঞ্জিনগুলোর ক্ষমতা অনেক বেশি ছিল। ইঞ্জিন দুটি দীর্ঘদিন অব্যবহৃতও ছিল। ইঞ্জিনে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি ছিল। লঞ্চ ছাড়ার পরই কিছু ত্রুটি ধরা পড়ার পরও গন্তব্যের উদ্দেশে চলতে থাকে।ইঞ্জিনের ত্রুটির কারণে প্রচণ্ড তাপ বের হয়। যাত্রীরা তাদের জবানবন্দিতে জানিয়েছে, চলন্ত অবস্থায় লঞ্চটির পাটাতন (ডেক) প্রচণ্ড গরম হচ্ছিল।

যে ডকইয়ার্ডে লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল, প্রতিবেদেন ওই ডকইয়ার্ডের মালিক মো. শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়াকে বিধি লঙ্ঘনের দায়ে দায়ী করা হয়েছে।লঞ্চের দুটি ইঞ্জিন পরিবর্তন করা হলেও নিয়ম অনুযায়ী শিপইয়ার্ড থেকে লঞ্চ নামানোর পর সার্ভেয়ার দিয়ে তা আর পরীক্ষা করানো কথা ছিল। কিন্তু তা করেননি লঞ্চটির কর্তৃপক্ষ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, লঞ্চটি তিন মাস বসা অবস্থায় ছিল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবার চালু হলেও নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের সদরঘাটের সার্ভেয়ার মো. মাহবুবুর রশীদ ও ইনস্পেকটর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির জন্য দায়ী করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে এ ঘটনায় লঞ্চটির মালিক হামজালাল শেখসহ চারজন, প্রথম শ্রেণির ইনচার্জ মাস্টার মো. রিয়াজ শিকদার, দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টার খলিলুর রহমান, প্রথম শ্রেণির ড্রাইভার মাসুম বিল্লাহ ও দ্বিতীয় শ্রেণির ড্রাইভার আবুল কালামকে দায়ী করা হয়েছে। এছাড়া লঞ্চের সুকানি ও গ্রিজারকেও এ ঘটনায় দায়ী করা হয়। তারা পলাতক রয়েছেন।